হারুন সালেমের মাসি : গল্পের সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ ও নোট
ভূমিকা -
বাংলা সাহিত্যের প্রতিবাদী ও শোষিত মানুষের কণ্ঠস্বর মহাশ্বেতা দেবীর ‘হারুন সালেমের মাসি’ গল্পটি এক অনন্য সমাজতাত্ত্বিক দলিল। এটি কেবল একটি ছোটগল্প নয়, বরং প্রান্তিক মানুষের লড়াই, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং রাষ্ট্রীয় অবিচারের বিরুদ্ধে এক বৃদ্ধার অকুতোভয় সংগ্রামের জীবন্ত আখ্যান। পাঠ্যসূচিতে এই গল্পটির অন্তর্ভুক্তির প্রধান কারণ হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের চেতনা জাগ্রত করা এবং সমাজের তথাকথিত ‘অপরাধী’ তকমার আড়ালে থাকা মানবিক সত্যকে চেনা। মাতৃত্ব যে কোনো নির্দিষ্ট রক্ত বা ধর্মের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে না—এই চিরন্তন সত্যটিই গল্পের মূল ভাব।
লেখক পরিচিতি -
মহাশ্বেতা দেবী (১৯২৬–২০১৬): মহাশ্বেতা দেবী বাংলা সাহিত্যের সেই বিরল প্রতিভা, যাঁর কলম চিরকাল সমাজ-কাঠামোর একদম তলার স্তরের মানুষের জন্য সোচ্চার হয়েছে।
- সাহিত্যভাবনা: তিনি রোমান্টিক কল্পনার চেয়ে রূঢ় বাস্তবতাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। আদিবাসী জীবন, নিম্নবর্গের মানুষের জীবনসংগ্রাম এবং রাষ্ট্রীয় শোষণের বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী ছিল ক্ষুরধার।
- লেখার বৈশিষ্ট্য: তাঁর গদ্য সহজ, ঋজু এবং মেদহীন। তিনি তথাকথিত আলঙ্কারিক ভাষার বদলে সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষাকে সাহিত্যিক মর্যাদা দিয়েছেন।
- অবদান: ‘হাজার চুরানির মা’, ‘অরণ্যের অধিকার’, ‘স্তন্যদায়িনী’ বা ‘দ্রৌপদী’-র মতো সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে এক নতুন ঘরানা তৈরি করেছেন। তিনি জ্ঞানপীঠ, সাহিত্য অকাদেমি এবং রামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
গল্পের বিষয় ও প্রেক্ষাপট -
‘হারুন সালেমের মাসি’ গল্পটি সত্তর ও আশির দশকের উত্তাল রাজনৈতিক এবং সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে রচিত। সত্তর দশকের নকশালবাড়ি আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে বাংলার শহর ও মফস্বলে এক গভীর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দানা বেঁধেছিল। পুলিশি তল্লাশি, এনকাউন্টার এবং যুবকদের ‘ফেরারি’ হওয়ার ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক।
গল্পটি এমন এক সমাজচিত্র তুলে ধরে যেখানে রাষ্ট্র ও পুলিশের চোখে হারুন বা সালেম সন্ত্রাসবাদী বা অপরাধী। কিন্তু মাসির জীর্ণ কুটিরটি এই রাজনৈতিক গোলকধাঁধার বাইরে এক অন্য ভূখণ্ড। সেখানে দারিদ্র্য আছে, কিন্তু ঘৃণা নেই। গল্পের প্রেক্ষাপটটি একদিকে অন্ধকারময় পুলিশি শাসন, অন্যদিকে মাসির আঁচলের তলায় থাকা মানবিক উত্তাপ—এই দুই বিপরীত বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
গল্পের থিম বিশ্লেষণ -
গল্পটির থিম বা কেন্দ্রীয় ভাব বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ফুটে ওঠে:
১. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উচ্চ আদর্শ: গল্পের কেন্দ্রীয় থিম হলো হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের উর্ধ্বে উঠে মানবিক সম্পর্কের জয়গান। হারুন (মুসলিম) ও সালেম (হিন্দু) দুই ভিন্ন ধর্মের হয়েও মাসির কাছে তারা ‘ঘরের ছেলে’। দাঙ্গা বা ধর্মীয় বিভেদ মাসির এই ছোট সাম্রাজ্যে প্রবেশ করতে পারেনি।
২. মাতৃত্বের সর্বজনীন রূপ: মাসি চরিত্রটি এখানে এক শাশ্বত আশ্রয়দাত্রীর প্রতীক। মাতৃত্ব যে কেবল জন্মদানের মাধ্যমে হয় না, বরং মমত্ব এবং সাহসের মাধ্যমেও তৈরি হতে পারে, তা মহাশ্বেতা দেবী নিপুণভাবে দেখিয়েছেন।
৩. রাষ্ট্র বনাম ব্যক্তি: রাষ্ট্র ও প্রশাসন যখন সাধারণ তরুণদের ওপর যান্ত্রিকভাবে শাসনের স্টিম রোলার চালায়, তখন মাসির মতো সাধারণ মানুষ তাঁদের নৈতিক সাহস দিয়ে প্রতিবাদ গড়ে তোলেন। পুলিশি ধমকের মুখে মাসির অবিচল থাকা আসলে এক নীরব রাজনৈতিক প্রতিবাদ।
৪. প্রান্তিক মানুষের সংগ্রাম: গল্পটি প্রান্তিক মানুষের চরম দারিদ্র্য এবং অস্তিত্ব রক্ষার সংকটের কথা বলে। এই সংকট কেবল পেটের ভাতের নয়, বরং এক সম্মানজনক জীবনেরও।
চরিত্র বিশ্লেষণ -
- মাসি: গল্পের প্রাণকেন্দ্র এবং অজেয় এক শক্তি। তিনি কেবল একজন বৃদ্ধা নন, বরং তিনি অকুতোভয় সাহস এবং অনাবিল স্নেহের আধার। পুলিশি তল্লাশির সময় তাঁর চতুরতা ও উপস্থিত বুদ্ধি প্রশংসনীয়। তিনি সমাজ বা রাষ্ট্রের তোয়াক্কা করেন না, কেবল নিজের মানবিক বোধের কাছে দায়বদ্ধ।
- হারুন ও সালেম: এই দুই যুবক গল্পের পার্শ্বচরিত্র হলেও গুরুত্বপূর্ণ। তারা তৎকালীন ব্যবস্থার শিকার হওয়া পথভ্রষ্ট যুবসমাজের প্রতিনিধি। তাদের মধ্যে কোনো ধর্মীয় দূরত্ব নেই; আছে একে অপরের প্রতি আস্থা এবং মাসির প্রতি অগাধ ভক্তি।
- পুলিশ ও প্রশাসন: গল্পে পুলিশ চরিত্রগুলিকে দেখা গেছে যান্ত্রিক ও নিষ্ঠুর শক্তি হিসেবে। তারা গল্পের নেতিবাচক শক্তি যারা মানবতার চেয়ে ‘আইন’ ও ‘অর্ডার’ পালনেই বেশি ব্যস্ত।
গল্পের ভাষা ও সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য -
মহাশ্বেতা দেবীর গল্প বলার কৌশল অত্যন্ত স্বতন্ত্র:
- বাস্তববাদী শৈলী: লেখিকা রূঢ় বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলতে কোনো আড়াল ব্যবহার করেননি। বস্তির পরিবেশ, পুলিশের আচরণ—সবই ছবির মতো স্পষ্ট।
- কথ্য সংলাপ: চরিত্রদের মুখে সাধারণ মানুষের ভাষা ব্যবহার করায় গল্পটি অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে মাসির সংলাপের মধ্যে এক ধরণের তেজ ও গ্রাম্যতা মিশে আছে যা চরিত্রটিকে আকর্ষণীয় করেছে।
- প্রতীকী ব্যবহার: মাসির ঘরটি এখানে একটি ‘নিরাপদ দ্বীপ’-এর প্রতীক, যেখানে বাইরের রাজনৈতিক ঝড় প্রবেশ করতে পারে না। হারুন ও সালেমের নাম দুটি এখানে দুই ধর্মের সংহতির প্রতীক।
গুরুত্বপূর্ণ শব্দার্থ -
| শব্দ | অর্থ | প্রাসঙ্গিক ব্যবহার |
| ফেরারি | পলাতক বা আত্মগোপনকারী | পুলিশি মামলা বা রাজনৈতিক কারণে যারা আত্মগোপন করে থাকে। |
| তপশিল | সরকারি তালিকাভুক্ত অনুন্নত সম্প্রদায় | নিম্নবর্গের মানুষের সামাজিক অবস্থান বোঝাতে ব্যবহৃত। |
| রেশন | নির্ধারিত ভোজ্য পণ্য | প্রান্তিক মানুষের টিকে থাকার নূন্যতম রসদ। |
| বেচাল | নিয়ম বহির্ভূত বা বিশৃঙ্খল | হারুন-সালেমের আচরণের ওপর পুলিশের নজরদারি বোঝাতে। |
| হুলিয়া | অপরাধীকে ধরার সরকারি বিজ্ঞপ্তি | রাষ্ট্রের চোখে হারুন-সালেমের আইনি পরিচিতি। |
| আঁচল | শাড়ির প্রান্তভাগ | এখানে মাসির আশ্রয় ও সুরক্ষার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত। |
উপসংহার -
পরিশেষে বলা যায়, ‘হারুন সালেমের মাসি’ গল্পটি কেবল একটি নির্দিষ্ট সময়ের রাজনৈতিক দলিল নয়, এটি এক সর্বজনীন মানবিক পাঠ। মহাশ্বেতা দেবী প্রমাণ করেছেন যে, স্নেহ এবং ভাতৃত্বই পারে চরম অরাজকতার মধ্যে বাঁচার পথ দেখাতে। সাম্প্রদায়িক হানাহানি এবং রাষ্ট্রের অমানবিক শাসনের বিরুদ্ধে মাসি এক অজেয় মানবিক বিদ্রোহের নাম। বর্তমান সময়ের অস্থির সমাজেও সম্প্রীতি ও চারিত্রিক সাহসের এই শিক্ষা গল্পটিকে চিরকাল প্রাসঙ্গিক করে রাখবে। ছাত্রছাত্রীদের জন্য এই গল্পটি তাই কেবল পরীক্ষার পাঠ নয়, বরং এক গভীর নৈতিক অভিজ্ঞতারও নাম।
পরীক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ টিপস: উত্তর লেখার সময় পাঠ্যবই থেকে মাসির দু-একটি তেজস্বী সংলাপ কোটেশন হিসেবে ব্যবহার করলে উত্তরের মান বহুগুণ বেড়ে যাবে।
*সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন শীঘ্রই আপলোড করা হবে।

Social Platforms