নানা রঙের দিন : নাটকের সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ ও নোট
ভূমিকা -
সাহিত্যজগতে নাটক একটি অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম, যা সমাজের জটিলতা, ব্যক্তিমানুষের অন্তরদ্বন্দ্ব এবং জীবনবাস্তবতাকে সরাসরি মঞ্চে প্রতিফলিত করে। নাটকের তাৎক্ষণিকতা দর্শককে সমাজের সঙ্গে এক নিবিড় আত্মীকরণের সুযোগ দেয়। এই প্রেক্ষাপটেই সম্ভাব্য নাট্যকার (যদিও মূল রচয়িতা হলেন রুশ নাট্যকার আন্তন চেখভ—বাংলায় এই নাটকের মূল রচয়িতার নাম উল্লেখ নেই, কিন্তু এটি চেখভের ‘সোয়ান সং’ অবলম্বনে রচিত) রচিত ‘নানা রঙের দিন’ নাটকটি আধুনিক বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এটি কেবল একটি মঞ্চসফল নাটক নয়, বরং আধুনিক মানুষের মনস্তাত্ত্বিক সংকট, শিল্পীর জীবনবোধ এবং সময়ের সঙ্গে মূল্যবোধের সংঘর্ষের একটি গভীর আলেখ্য। দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে নাটকটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে নাটকের আঙ্গিক বিশ্লেষণ, মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা এবং শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবনবোধ অনুধাবনের ক্ষেত্রে বিশেষ শিক্ষামূলক গুরুত্ব বহন করে। এই নাটকটি শিল্প ও জীবনের এক অনিবার্য দ্বন্দ্বকে তুলে ধরে, যা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
১. নাট্যকার পরিচিতি -
‘নানা রঙের দিন’ নাটকটি রুশ নাট্যকার আন্তন পাভলোভিচ চেখভের (Anton Pavlovich Chekhov, ১৮৬০-১৯০৪) ‘সোয়ান সং’ (Swan Song) অবলম্বনে রচিত। যদিও এই বাংলা অনুবাদ বা রূপান্তরে নাট্যকারের নাম সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি, তবুও এর মূল ভাব, শৈলী এবং চরিত্রায়নে চেখভের গভীর প্রভাব সুস্পষ্ট।
চেখভের সাহিত্য পটভূমি ও শৈলী: চেখভ ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগের একজন কিংবদন্তী রুশ নাট্যকার ও ছোটগল্পকার। তাঁর সাহিত্যকর্মগুলি মূলত বাস্তববাদী ও প্রতীকী ঘরানার। তিনি জীবনের সাধারণ মুহূর্তগুলি, মানুষের তুচ্ছ আশা-আকাঙ্ক্ষা, ব্যর্থতা এবং একাকীত্বকে অত্যন্ত সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। চেখভের নাটকগুলিতে তথাকথিত 'ঘটনা' কম থাকে, কিন্তু চরিত্রের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, নীরব বেদনা এবং পরিবেশের সঙ্গে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা অত্যন্ত জোরালোভাবে ফুটে ওঠে। তাঁর নাটকে প্রায়শই জীবনের নিরর্থকতা এবং সময়ের ক্ষয়িষ্ণুতা একটি বিষাদের সুর তৈরি করে।
নাটকীয় অবদান: চেখভের প্রধান নাটকগুলি—যেমন ‘দি সিগাল’, ‘থ্রি সিস্টার্স’ এবং ‘দি চেরি অরচার্ড’—বিশ্বজুড়ে মঞ্চসফল এবং আধুনিক নাটকের গতিপথ পরিবর্তন করে দিয়েছে। তাঁর নাটকের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—সংলাপের মাধ্যমে চরিত্রগুলির নীরব যন্ত্রণাকে ফুটিয়ে তোলা এবং সাধারণ জীবনের গভীর তাৎপর্য আবিষ্কার করা। ‘নানা রঙের দিন’ নাটকটিও চেখভের সেই শৈলী অনুসরণ করে এক বর্ষীয়ান শিল্পীর জীবনের হতাশা ও ব্যর্থতার গল্পকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিশ্লেষণ করেছে। বাংলা সাহিত্যে এই ধরনের মনস্তত্ত্বনির্ভর নাটকগুলি অনুবাদ ও রূপান্তরের মাধ্যমে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল।
২. নাটকের বিষয় ও প্রেক্ষাপট -
‘নানা রঙের দিন’ নাটকটির বিষয়বস্তু হলো একজন বর্ষীয়ান অভিনেতার জীবনের শেষ দৃশ্যের একাকীত্ব, হতাশা এবং আত্মপর্যালোচনা। নাটকের মূল চরিত্র, রজনী চাটুজ্জে, মঞ্চজীবনে অজস্র যশ, খ্যাতি ও প্রেম লাভ করলেও জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে চরম একাকীত্বে ভোগেন।
সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট: নাটকটি মূলত শিল্পীর জীবন ও সমাজের সম্পর্ককে প্রশ্ন করে। সমাজে খ্যাতি বা অর্থ থাকলেও শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবনে যে শূন্যতা ও বিচ্ছিন্নতা থাকতে পারে, নাটকটি সেই মনস্তাত্ত্বিক সত্যকে তুলে ধরে। প্রেক্ষাপটটি একটি নির্জন মঞ্চের ভেতরের দৃশ্য, যেখানে গভীর রাতে একজন মদ্যপ অভিনেতা অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করছেন। এই নির্জনতা এবং রাতটিই অভিনেতার জীবনের শেষ সময়, যখন তার কাছে তার অতীত জীবন, ব্যর্থ প্রেম এবং মঞ্চের প্রতি তার নিবিড় ভালোবাসার হিসাবনিকাশ করার সুযোগ আসে।
কেন্দ্রীয় সমস্যা: নাটকটি যে কেন্দ্রীয় সমস্যাগুলিকে উত্থাপন করে, তা হলো—
- বার্ধক্যের হতাশা: যৌবনের তেজ ও খ্যাতি ফুরিয়ে গেলে শিল্পীর জীবনে যে অবহেলার দিন আসে।
- ব্যক্তিগত শূন্যতা: অজস্র মানুষের ভালোবাসা পাওয়া সত্ত্বেও ব্যক্তিগত জীবনে কোনো আপনজনের অনুপস্থিতি।
- জীবনের হিসাব: মঞ্চে সফল হলেও জীবনে ভালোবাসার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা।
- শিল্পের প্রতি ভালোবাসা: চরম হতাশার মধ্যেও মঞ্চের প্রতি শিল্পীর অনিবার্য আকর্ষণ।
নাটকটি এই সমস্ত প্রশ্নকে একাকীত্বের আবহে উত্থাপন করে, যা দর্শকদের ভাবায় যে, খ্যাতি এবং জীবনের সার্থকতা কি এক?
৩. নাটকের কাহিনি সংক্ষেপ -
নাটকটির কাহিনি সরল, কিন্তু এর মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা অত্যন্ত জটিল। কাহিনিটি সম্পূর্ণ এক একক অঙ্কের নাটক হিসেবে মঞ্চস্থ হয়।
গভীর রাতে মঞ্চের আলো নিভে যাওয়ার পর, নাটকের একমাত্র প্রধান চরিত্র রজনী চাটুজ্জে (একজন বর্ষীয়ান মঞ্চাভিনেতা) মঞ্চে প্রবেশ করেন। তিনি মদ্যপানরত অবস্থায় মঞ্চের এক কোণে একাকী বসে আছেন। তাঁর কাছে একমাত্র সঙ্গী হলো নাট্যমঞ্চের প্রম্পটার, কালীনাথ সেন।
প্রথমেই রজনী চাটুজ্জে তাঁর বার্ধক্যজনিত হতাশা এবং শারীরিক ক্লান্তি প্রকাশ করেন। তিনি অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করেন, যখন মঞ্চে তাঁর ছিল অসামান্য দাপট এবং দর্শক তাঁকে বিপুল ভালোবাসা দিত। এই সময় তিনি তাঁর জীবনের ব্যর্থ প্রেমের কথাও উত্থাপন করেন—যৌবনে একজন সাধারণ মেয়ে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, কারণ সে ছিল একজন অভিনেতা। রজনী মনে করেন, অভিনেতারা তাদের জীবনে প্রকৃত ভালোবাসা পায় না, তারা কেবল নকল আবেগের কারবারি।
কালীনাথ সেন তাঁকে শান্ত করতে চেষ্টা করেন এবং রজনীর দীর্ঘ অভিনয় জীবনের বিস্ময়কর সাফল্যের কথা মনে করিয়ে দেন। এই স্মৃতিচারণ করতে গিয়েই রজনী হঠাৎ করে মঞ্চে তাঁর অভিনীত বিভিন্ন বিখ্যাত নাটকের দৃশ্যাবলী আবৃত্তি ও অভিনয় করতে শুরু করেন। তিনি তার জীবনের সেরা কিছু ভূমিকার অংশ অভিনয় করে দেখান, যেমন 'নানা রঙের দিন' নাটকের সেই বিখ্যাত দৃশ্যটি।
এই অভিনয় করার মুহূর্তে রজনী যেন তার হারিয়ে যাওয়া যৌবন এবং মঞ্চের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসা ফিরে পান। অভিনয় করতে করতেই তিনি হঠাৎ বুঝতে পারেন যে, তাঁর জীবন আসলে ছিল "নানা রঙের দিন" — বিভিন্ন চরিত্রের রঙে রাঙানো। ব্যক্তিগত জীবন শূন্য হলেও, মঞ্চই ছিল তার আসল জীবন, তার প্রেম।
নাটকের শেষে, রজনী চাটুজ্জে চরম হতাশা এবং ক্লান্তি সত্ত্বেও মঞ্চ ছেড়ে যেতে পারেন না। কালীনাথ সেন তাঁর একাকীত্ব দূর করতে পারেননি, কিন্তু রজনী তার জীবনের একমাত্র সত্যকে আবিষ্কার করেন—অভিনয়ই তার জীবনের একমাত্র প্রেম ও শিল্পই তার অস্তিত্ব। নাটকটি এই নীরব আবিষ্কার এবং বার্ধক্যের হতাশাকে ফুটিয়ে তুলেই শেষ হয়।
৪. নাটকের থিম বিশ্লেষণ -
‘নানা রঙের দিন’ নাটকটি একাধিক গভীর থিমকে ধারণ করে, যা নাটকটিকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে সমৃদ্ধ করেছে:
ক. শিল্পীর একাকীত্ব ও ব্যক্তিগত শূন্যতা -
নাটকের প্রধানতম থিম এটি। রজনী চাটুজ্জে মঞ্চে বিপুল জনপ্রিয় হলেও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি চরম একা। তিনি অজস্র মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন, কিন্তু সেই ভালোবাসা ছিল তার চরিত্রের জন্য, তার ব্যক্তিজীবনের জন্য নয়। এই কারণে যৌবনে তার প্রেমিকা তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। নাটকটি দেখায় যে, শিল্পীরা পর্দার আড়ালে কতটা নিঃসঙ্গ ও শূন্য জীবন যাপন করতে পারে।
খ. বার্ধক্যজনিত হতাশা ও সময়ের ক্ষয় -
রজনী চাটুজ্জে বার্ধক্যের কারণে মঞ্চের সেই আগের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁর শরীরের ক্লান্তি, কণ্ঠস্বরের দুর্বলতা এবং স্মৃতিচারণের মাধ্যমে সময়ের ক্ষয়িষ্ণুতা তুলে ধরা হয়েছে। যৌবনের তেজ ফুরিয়ে যাওয়ায় তিনি নিজেকে মূল্যহীন মনে করছেন। এটি শিল্পীর জীবনের এক অনিবার্য ট্র্যাজেডি।
গ. জীবন ও শিল্পের অনিবার্য দ্বন্দ্ব -
নাটকের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো জীবন এবং শিল্পের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব। রজনী চাটুজ্জে যখন মঞ্চে অভিনয় করেন, তখন তিনি পূর্ণ। কিন্তু যখন তিনি জীবনের স্বাভাবিক ভূমিকা পালন করতে চেয়েছেন (যেমন প্রেম), তখন তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। শিল্পের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা জীবনকে তাঁর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি উপলব্ধি করেন যে, শিল্পই তাঁর একমাত্র সত্য প্রেম।
ঘ. মূল্যবোধের সংঘর্ষ: যশ বনাম ভালোবাসা -
রজনীর জীবনে যশ (খ্যাতি) এবং ভালোবাসা (ব্যক্তিগত সম্পর্ক) এই দুইয়ের মধ্যে সংঘর্ষ দেখা যায়। তিনি মঞ্চের যশকে বেছে নিয়েছিলেন, কিন্তু এর ফলে তিনি ব্যক্তিগত ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হন। নাটকটি প্রশ্ন তোলে যে, জীবনের কোন মূল্যটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ: শিল্পের উচ্চতা নাকি মানবিক সম্পর্কের উষ্ণতা?
ঙ. আশাবাদ ও শিল্পের প্রতি অবিচল আস্থা -
চরম হতাশা সত্ত্বেও, নাটকটি শিল্পের প্রতি এক ধরনের অবিচল আস্থা নিয়ে শেষ হয়। রজনী যখন পুনরায় মঞ্চে অভিনয় শুরু করেন, তখন তিনি সাময়িকভাবে হলেও তাঁর হতাশা ভুলে যান। এটি প্রমাণ করে, শিল্পীর জীবনে চূড়ান্ত সত্য হলো তার শিল্প, যা তাকে জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও টিকে থাকার শক্তি জোগায়।
৫. চরিত্র বিশ্লেষণ -
নাটকটিতে প্রধানত দুটি চরিত্র থাকলেও, রজনী চাটুজ্জের মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা এটিকে একক চরিত্র-নির্ভর নাটকের মর্যাদা দিয়েছে।
ক. রজনী চাটুজ্জে (প্রধান চরিত্র)
রজনী চাটুজ্জে হলেন নাটকের কেন্দ্রবিন্দু—একজন বর্ষীয়ান, মদ্যপ এবং একাকী মঞ্চাভিনেতা।
- অভিনেতা হিসেবে: তিনি এককালে মঞ্চের কিংবদন্তী ছিলেন। তাঁর কণ্ঠে নাটকগুলির সংলাপ যেন পুনরায় জীবন ফিরে পায়।
- ব্যক্তি হিসেবে: তিনি চরম হতাশাবাদী। বার্ধক্যের সঙ্গে আসা শারীরিক দুর্বলতা, অতীত প্রেমের ব্যর্থতা এবং ব্যক্তিগত শূন্যতা তাঁকে গ্রাস করেছে। তিনি নিজেকে "নকল আবেগ" বিক্রেতা মনে করেন।
- মনস্তাত্ত্বিক দিক: তাঁর চরিত্রের গভীরতা হলো—তিনি শিল্পের প্রতি তাঁর ভালোবাসাকে কখনোই অস্বীকার করতে পারেননি। চরম হতাশার মুহূর্তেও তিনি যখন অতীতের ভূমিকার অভিনয় করেন, তখন তিনি যেন সাময়িকভাবে নিজের জীবনের সত্যকে পুনরুদ্ধার করেন। তাঁর চরিত্র শিল্পের কাছে জীবনের আত্মসমর্পণের প্রতীক।
খ. কালীনাথ সেন (সহযোগী চরিত্র/প্রম্পটার)
কালীনাথ সেন হলেন রজনীর নাট্যমঞ্চের প্রম্পটার এবং নীরব শ্রোতা।
- ভূমিকা: তিনি রজনীর একাকীত্বের একমাত্র সাক্ষী। তিনি রজনীকে শান্ত করার এবং তাঁর অভিনয় জীবনের গৌরব মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
- তাৎপর্য: কালীনাথ মূলত রজনীর স্মৃতিচারণের এবং আত্মবিশ্লেষণের জন্য একটি পটভূমি হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর উপস্থিতি রজনীর একাকীত্বকে আরও তীব্রভাবে ফুটিয়ে তোলে, কারণ কালীনাথ রজনীর মনের গভীরে প্রবেশ করতে পারেন না, তিনি কেবল একজন বহিরাগত দর্শক।
৬. গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ ও শব্দার্থ -
নাটকের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ ও শব্দের বিশ্লেষণ:
| সংলাপ/শব্দ | প্রসঙ্গ | অর্থ/ব্যাখ্যা |
| "সব আছে, শুধু নেই। কিচ্ছু নেই।" | মঞ্চে মদ্যপ অবস্থায় রজনীর হতাশা প্রকাশ | জীবনের অজস্র খ্যাতি সত্ত্বেও ব্যক্তিগত জীবনে চরম শূন্যতা ও একাকীত্বের অনুভূতি। |
| "এ কী রকম জীবন আমাদের—নকল মানুষের নকল ভালোবাসা।" | অতীতের প্রেমিকার প্রত্যাখ্যান মনে করে রজনীর মন্তব্য | শিল্পীদের জীবনে যে ভালোবাসা আসে, তা তাদের অভিনয় করা চরিত্রের জন্য, ব্যক্তিগত সত্তার জন্য নয়—এই দুঃখ। |
| "নানা রঙের দিন।" | রজনীর জীবনের চরম উপলব্ধি | নিজের জীবনের বহু বছর বিভিন্ন নাটকের চরিত্রে অভিনয় করতে করতেই কেটে গেল—নিজস্ব সত্তার চেয়ে চরিত্রের রঙে বেশি রাঙানো জীবন। |
| বার্ধক্যজনিত | শব্দ | বার্ধক্যের কারণে সৃষ্ট (ক্লান্তি, দুর্বলতা ইত্যাদি)। |
| প্রম্পটার | শব্দ | নাটকের সংলাপ ভুলে গেলে যে মনে করিয়ে দেয়। |
| স্বীকৃতি | শব্দ | অনুমোদন বা সম্মান। |
৭. নাট্যকৌশল ও শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য -
‘নানা রঙের দিন’ নাটকটি তার শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য এবং নাট্যকৌশলের দিক থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী।
ক. সংলাপ ও মনস্তাত্ত্বিকতা -
নাটকটিতে সংলাপের আধিক্য থাকলেও তা মূলত মনস্তাত্ত্বিক সংলাপ। রজনীর বেশিরভাগ কথাই আত্মসমালোচনা, আত্মধিক্কার এবং স্মৃতিচারণ। সংলাপগুলি সরল হলেও তার মধ্যে গভীর বিষাদের সুর এবং বার্ধক্যের হতাশা লুকিয়ে আছে। কালীনাথের সংলাপগুলি রজনীর হতাশার পটভূমি তৈরি করে।
খ. মঞ্চ পরিকল্পনা ও প্রতীকী ব্যবহার -
নাটকের মঞ্চ পরিকল্পনা অত্যন্ত প্রতীকী। একটি নির্জন, অন্ধকার মঞ্চ (নাটকের শেষে সমস্ত আলো নিভে যায়) রজনীর জীবনের একাকীত্ব এবং অবসানের প্রতীক। রজনী চাটুজ্জের মদ্যপান তাঁর জীবনের হতাশা ও শূন্যতা এড়ানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টার প্রতীক।
গ. দ্বন্দ্ব নির্মাণ -
এই নাটকে বহিরাগত দ্বন্দ্ব অনুপস্থিত। এখানে প্রধান দ্বন্দ্ব হলো রজনীর ভেতরের দ্বন্দ্ব—তার শিল্পী সত্তা ও ব্যক্তিগত সত্তার দ্বন্দ্ব, যৌবনের আকাঙ্ক্ষা ও বার্ধক্যের বাস্তবতার দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব নির্মাণ নাটকটিকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে সমৃদ্ধ করেছে।
ঘ. নাটকের আঙ্গিক -
নাটকটি একক অঙ্ক বিশিষ্ট, এবং এর চরিত্র সংখ্যা কম। এই আঙ্গিকটি রজনী চাটুজ্জের একাকীত্বকে আরও তীব্রভাবে ফুটিয়ে তুলেছে এবং দর্শকের মনোযোগ শুধুমাত্র প্রধান চরিত্রের আভ্যন্তরীণ সংকটের দিকে নিবদ্ধ করেছে।
ঙ. নাটকীয় উত্তেজনা -
যদিও নাটকের কাহিনিতে কোনো আকস্মিক ঘটনা নেই, তবুও রজনীর অতীতের স্মরণ এবং তার অতীতের বিখ্যাত ভূমিকার অভিনয় করার মুহূর্তগুলি নাটকীয় উত্তেজনা তৈরি করে, যা দর্শককে রজনীর মনস্তত্ত্বের গভীরে নিয়ে যায়।
৮. নাটকের সামাজিক ও শিক্ষামূলক গুরুত্ব -
‘নানা রঙের দিন’ নাটকটির সামাজিক ও শিক্ষামূলক গুরুত্ব অপরিসীম।
সামাজিক গুরুত্ব: এই নাটকটি সমাজের কাছে একটি প্রশ্ন রাখে—শিল্পীদের ব্যক্তিগত জীবনের মূল্য কতটুকু? এটি দেখায় যে, শিল্পীরা সমাজে খ্যাতি লাভ করলেও তাদের ব্যক্তিগত জীবনে চরম একাকীত্ব ও শূন্যতা বিরাজ করতে পারে। এটি কেবল অভিনেতাদের সমস্যা নয়, বরং সমাজের সমস্ত সফল মানুষের ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্নতা ও বার্ধক্যের হতাশার একটি সাধারণ প্রতিচ্ছবি।
শিক্ষামূলক গুরুত্ব: দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য এই নাটকটি মনস্তত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব এবং শিল্পের প্রতি অঙ্গীকারের ধারণা অনুধাবনে সাহায্য করে। শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারে যে, নাটক কেবল ঘটনা নির্ভর নয়, বরং চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং জীবনের গভীরতর প্রশ্নগুলির উত্থাপনের মাধ্যমেও অত্যন্ত শক্তিশালী হতে পারে। এটি জীবনের যশ-খ্যাতি এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার শিক্ষাও দেয়।
৯. উপসংহার -
‘নানা রঙের দিন’ নাটকটি একটি বিষাদময় এবং গভীরভাবে মনস্তাত্ত্বিক শিল্পকর্ম। রজনী চাটুজ্জের একাকীত্ব, তাঁর মদ্যপান এবং তাঁর অতীতের মহিমা স্মরণ—এ সবই জীবন ও শিল্পের এক অনিবার্য ট্র্যাজেডিকে তুলে ধরে। নাটকটির চূড়ান্ত বার্তা হলো, জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও একজন শিল্পী তার শিল্পের কাছেই একমাত্র স্বস্তি ও সার্থকতা খুঁজে পান। খ্যাতি, অর্থ, বা ব্যক্তিগত সম্পর্ক—সবই ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু শিল্পের প্রতি ভালোবাসা অমর। এই নাটকটি শৈল্পিক মূল্যবোধের দিক থেকে এক মাস্টারপিস এবং আজকের শিক্ষার্থীদের জন্য জীবন ও সাফল্যের সংজ্ঞা পুনর্বিবেচনা করার এক গুরুত্বপূর্ণ আহ্বান।
সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন : Click Here & Download PDF

Social Platforms